আজ সোমবার, ২৭শে মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মাদারীপুর স্পিনিং মিল বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা অনাহারে অদ্ধহারে দিন কাটাচ্ছে

মাদারীপুর স্পিনিং মিল বন্ধ

মাদারীপুর স্পিনিং মিল বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা অনাহারে অদ্ধহারে দিন কাটাচ্ছে
মাদারীপুর স্পিনিং মিল বন্ধ

শহিদুল ইসলাম লিখন মাদারীপুর॥
মাদারীপুর সদর উপজেলার মস্তফাপুর এলাকায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশে ৩৩ একর জমির উপর জেলার একমাত্র মাদারীপুর স্পিনিং মিলটি প্রতিষ্ঠিত। ১৯৭৮ সালে সরকারিভাবে মিলটি প্রতিষ্ঠিত হলেও আনুষ্ঠানিক উৎপাদন শুরু করে ১৯৮১ সালে। সরকার ১৩ বছর মিলটি চালানোর পরে ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে সরকার কিশোরগঞ্জের এক ব্যবসায়ীর কাছে মিলটি বিক্রি করে দেয়। মিলটি ব্যক্তি মালিকানাধীন হওয়ার পর থেকে ভালোই চলছিল। মাসে ১২শ থেকে ১৫শ বেল সুতা উৎপাদন হতো মিলটিতে। তিন সিফটে প্রায় এক হাজার পাঁচশ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক কাজ করতো।

২০১৭ সালের ১৩ জুলাই রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে অতিরিক্ত সচিব রীনা পারভীনের স্বাক্ষরকৃত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে মিলটি বিটিএমসির নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত করা হয়। বিটিএমসির পক্ষ থেকে প্রজ্ঞাপনটি জেলা প্রশাসকের কাছে দিলে ১৪ জুলাই শুক্রবার সকালে জেলা প্রশাসক আইনশৃঙ্গলা বাহিনীর সহযোগিতায় সম্পূর্ন চালু অবস্থায় মিলটি সিলগালার মাধ্যমে বন্ধ করে দেয় এবং পরবর্তীতে বিটিএমসির কর্মকর্তাদের কাছে মিলটির দায়িত্ব সম্পূর্ন বুঝিয়ে দেয়া হয়।

এরপর থেকে প্রায় ৬ মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত মিলটি চালু না হওয়ায় মিলের প্রায় ১৫শ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। মিলের বেশির ভাগ শ্রমিক ছিল স্থানীয় গরীব ও অসহায় মহিলারা। যাদের সংসারের সম্পূর্ন ব্যয় নির্ভর করতো তাদের বেতনের উপর। এখন মিল বন্ধ থাকায় এবং আয়ের একমাত্র পথটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায পরিবার পরিজন নিয়ে শ্রমিকরা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছে। শ্রমিকদের দাবি সরকার বা মালিক যেই মিল চালাক না কেন সেটা তাদের দেখার বিষয় না। তারা চায় মিলটি যেন দ্রুত চালু হয় এবং তারা পূর্বের ন্যয় কাজ করতে পারে। এখন বিটিএমসির একজন ম্যানেজার ইনচার্জ ও আনসার সদস্যসহ মোট ১৩ জন লোক মিলের ভিতরে রক্ষনাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে।

মিলের শ্রমিক মাজেদা কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমাদের অনেকের স্বামী নাই। এখানকার বেতন দিয়ে সংসার চলতো। বহু অসহায় মেয়ে আছে তারা এই মিলে কাজ করতো। এখন খুবই দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছি। আমরা জানি এই সরকার শ্রমিক বান্ধব সরকার। তাই সরকারের কাছে দাবি জানাই তারা যেন দ্রুত মিলটি চালু করে দেয়।
মিলের আরেক শ্রমিক মাহিনুর বলেন, প্রায় ৬ মাস ধরে মিলটি বন্ধ হয়ে আছে। আমরা ছেলে-মেয়ে নিয়ে মাঝে মধ্যে অনাহারে দিন কাটাতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই তিনি যেন মিলটি তাড়াতাড়ি খুলে দেয়।মাদারীপুর স্পিনিং মিল বন্ধ

নাম না প্রকাশ করার শর্তে মিলের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে অন্যতম একটি মিল হচ্ছে এটি। ব্যক্তি মালিকানায় আসার পর থেকে ভালো চলছিল মিলটি। জেলার বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এ মিলে, বিশেষ করে মস্তফাপুর এলাকার গরীব, অসহায় মহিলারা মিলে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। মস্তফাপুর বাজার ও বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ভ্যান চালক, ইজিবাইক চালক সহ বিভিন্ন মানুষের জীবিকা জড়িত ছিল এই মিলকে ঘিরে। মানুষের কর্মসংস্থান ও এলাকার উন্নয়নের জন্য হলেও মিলটি সরকার বা মালিকানার মাধ্যমে চালু রাখা উচিত। মিলটি বেশি দিন বন্ধ থাকলে কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। সরকার যে প্রজ্ঞাপনে মিলটি বন্ধ করে দিয়েছে তাতে পাওনা টাকার পরিমান উল্লেখ করে নাই। টাকার কথা বলা ছিল না। তারা অন্যান্য কারন দেখিয়ে মিলটি বন্ধ করে দেয়।

বিটিএমসি’র উপ-মহাব্যবস্থাপক কাজী ফিরোজ হোসেন বলেন, মিলটি বন্ধের প্রধান ইস্যু শুধু টাকা নয়, এর সাথে আরো অন্যান্য বিষয় জড়িত আছে। সরকারের সাথে মালিকের যে চুক্তি ছিল তা মালিক পক্ষ রাখেনি। সরকারের পক্ষ থেকে বার বার মালিক পক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য । কিন্তু মালিক পক্ষ একবারের জন্যও আমাদের সাথে যোগাযোগ করেনি এবং চিঠির কোন উত্তরও দেয়নি। তাছাড়াও মালিক ব্যাংক থেকে যে ঋণ নিয়েছে তাও সঠিকভাবে ব্যবহার করেনি। ব্যাংকের ঋণও পরিশোধ করে নাই। সব কিছু মিলে আমরা মিলটি বন্ধ করে দেই এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। পরবর্তীতে আমরা মিলটি বিটিএমসির মাধ্যমে চালানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলাম। এ সময় মালিক পক্ষ হাইকোর্টে একটি রির্ট করে এ জন্যই মিলটি চালু করতে বিলম্ব হচ্ছে। হাইকোর্ট থেকে রিটের নিষ্পত্তি হলে এবং যদি রায় আমাদের পক্ষে আসে তা হলে আমরা যত দ্রুত সম্ভব মিলটি চালু করে দিবো। কারন মিলের সাথে বহু লোকের কর্মসংস্থান জড়িত।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রনালয়ের নির্দেশ মোতাবেক আমরা মাদারীপুর স্পিনিং মিলটি মালিকের কাছ থেকে সরকারের দখলে এনে দেই। মালিক যিনি মিলটি চালানোর জন্য সরকারের কাছ থেকে বন্ধবস্ত নিয়েছিলেন কিন্তু তিনি সরকারের পাওনা টাকা পরিশোধ করেন নাই দীর্ঘদিন। টাকা পরিশোধের জন্য তার সাথে বার বার যোগাযোগ করা হয়েছে, পত্র দেয়া হয়েছে কিন্তু তিনি তাতে কোন সাড়া দেননি। সর্বশেষ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মিলটি সরকারের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারি এই সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর আমরা চলমান মিলটি বন্ধ করে সরকারের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসি এবং পরবর্তীতে বিটিএমসিকে মিলটির দায়িত্ব বুঝিয়ে দেই।

সরকার মিলের মালিকের কাছে পাবে আমার জানা মতে মাত্র ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার মত । আর রুপালী ব্যাংক থেকে মালিক ঋণ নিয়েছে প্রায় ৭শ কোটি টাকার মত। এত টাকা ঋণ নিয়ে সরকারের সামান্য টাকা পরিশোধ করতে পারলো না। এতে বোঝা যায় মালিকের অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে। সেটা এখন খতিয়ে দেখতে হবে।

তারপর থেকে দীর্ঘদিন যাবত মিলটি বন্ধ আছে। মিলের শ্রমিকরা তাদের বকেয়া টাকা পাওয়ার জন্য আমাদের কাছে বিভিন্ন সময় এসেছে। আমরা কর্তৃপক্ষকে শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্শশার কথা বলেছি। কর্তৃপক্ষ আশ^াস দিয়েছেন তারা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত মিলটি বন্ধ আছে। মিলটি চালু করার ব্যপারে বা অন্য কাউকে দেয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আমরা কিছু জানিনা। তবে মিলটি যদি চালু করা যায় তা হলে বেকার সমস্যার সমাধান হবে, এলাকার উন্নয়ন হবে। আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী মিলটি বন্ধ করে দেই এবং সরকারের পক্ষ থেকে যদি মিলটি খুলে দেয়ার ব্যাপারে নির্দেশ আসে তা হলে পুনরায় মিলটি খুলে দিবো বা মালিক পক্ষকে বুঝিয়ে দিবো। এর বেশি কিছু আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়।

রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে প্রজ্ঞাপনে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা হুবহু তুলে ধরা হলোঃ
যেহেতু, সরকারের সিদ্ধান্তক্রমে বেসরকারি খাতকে শক্তি শালীকরণের মাধ্যমে দেশের জাতীয় উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালে প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রয়ত্ত খাতে মাদারীপুর টেক্সটাল মিলস্ লি. মাদারীপুর বিক্রয় করা হয়। এ প্রেক্ষিতে গত ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৪ তারিখে সরকারের সাথে ক্রেতার একটি বিক্রয়চুক্তি সম্পাতি হয়। অত:পর বিক্রয় চুক্তি মোতাবেক মিলটির দখল ক্রেতার নিকট ১৯৯৪ সালে হস্তান্তর করা হয়। মিলটি ক্রেতার নিকট হস্তান্তর করার দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও মিল ক্রেতা মিলটি চালু করেনি। ফলে সরকারের মিলটি বিক্রয়ের লক্ষ ও উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়েছে।
যেহেতু মিল ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ-কে মিলের নিকট দীর্ঘ মেয়াদী ঋণের কিস্তি বাবদ সরকারি পাওনা পরিশোধের জন্য ১৫.০৪.২০০৯, ০৪.০৬.২০০৯, ১৩.০৭.২০১১, ০৩.০৫.২০১২, ২১.০৪.২০১৩, ২৭.০৩.২০১৭ তারিখে তাগিদপত্র ও চূড়ান্ত নোটিশ প্রদান করা সত্ত্বেও ক্রেতা সরকারি পাওনার একটি কিস্তিও পরিশোধ করে নাই;
যেহেতু, বিক্রিত মাদারীপুর টেক্সটাইল মিলস্ মাদারীপুর এর ক্রেতা দীর্ঘ মেয়াদী ঋণের কিস্তি বাবদ সরকারি পাওনা পরিশোধ না করে বিক্রয়চুক্তির ধারা লংঘন করেছে;
যেহেতু, মিল কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন যাবৎ মিল পরিচালনা না করে বন্ধ অবস্থায় ফেলে রেখেছে, হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীকে তাদের কর্মসংস্থান হতে বঞ্চিত করে রেখেছেন, এতে মিল হস্তান্তরের উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে এবং বিক্রয়চুক্তি লংঘিত হয়েছে;
যেহেতু, জনস্বার্থে ঈড়হঃৎধপঃ অপঃ ১৮৭২(ওঢ ড়ভ ১৯৭২) এর ৩৯নং ধারা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৪ তারিখে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করা হলো। এতদ্বারা বিক্রিত মাদারীপুর টেক্সটাইল মিলস্ লি. মাদারীপুরস্থ কারখানাটিসহ উক্ত কোম্পানির যাবতীয় শেয়ার, অন্যান্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ও স্বত্ব সরকার কর্তৃক অদ্য ১৩ জুলাই ২০১৭ খ্রি./ ২৯ আষাঢ় ১৪২৪ বঙ্গাব্দ তারিখে পুণ:গ্রহণ (ঞধশব ইধপশ)